১৮৯৩ সালের জুলাইতে ইয়োকোহামা থেকে ভ্যাঙ্কুবার অভিমুখে চলেছে জাহাজ। বহু যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন দুই ভারতীয়৷ এক মধ্যবয়স্ক পারসির সঙ্গে আলাপ হল মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, গেরুয়া পোশাক পরিহিত বছর তিরিশের এক বঙ্গসন্তানের৷ জাহাজের ডেকে জমে উঠল তাঁদের আড্ডা৷ গেরুয়া পোশাকে স্বামী বিবেকানন্দ এবং অন্যজন হলেন আধুনিক ভারতবর্ষের শিল্পের জনক জামশেদজি টাটা৷
বিবেকানন্দ চলেছেন শিকাশো বিশ্ব মহাধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে। বাণিজ্যের আশায় মার্কিন মুলুকে পাড়ি দিয়েছেন টাটা৷ সেদিনের আলাপচারিতা থেকেই জামশেদজি টাটা উৎসাহিত হয়েছিলেন দেশে ইস্পাত কারখানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার৷ সেদিনের আলোচনায় উঠে এসেছিল ভারতের ভবিষ্যত অর্থনীতি ও বাণিজ্যের প্রসঙ্গ৷
জাপানে দেশলাইয়ের কারখানা দেখেছেন তাঁরা৷ বিবেকানন্দ প্রশ্ন করেছিলেন জাপান থেকে দেশলাই আমদানি না করে ভারতেই কেন দেশলাই কারখানা গড়ছেন না? স্বদেশি উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে টাটাকে তাঁর পরামর্শ ছিল- জিনিস কেনা বেচায় কিছু লাভ আছে ঠিকই, কিন্তু নিজের দেশে কারখানা গড়তে পারলে মুনাফা অনেক বেশি ৷ কারখানা গড়লে কর্মসংস্থানও হবে৷ পশ্চিমের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভারতে কারখানা গড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বামীজি৷ বয়সে প্রায় ২৪বছরের ছোট সন্ন্যাসীর কাছ থেকে এমন অভিমত পেয়ে খুশি হয়েছিলেন জামশেদজী টাটা৷
কথা প্রসঙ্গে বাঙালি সন্ন্যাসী তাঁর সহযাত্রী পারসি শিল্পোদ্যোগীর কাছে তুলে ধরেছিলেন ব্রিটিশ শাসন কীভাবে দেশের মানুষকে অত্যাচার করছে। মানুষ দুবেলা অন্নও জোটাতে পারছে না। এই অবস্থায় আপামর জনসাধারণের জন্য শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান কতটা জরুরি৷ বিশদে জামশেদজিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত৷
জামশেদজি টাটা সেই সময় বিবেকানন্দকে জানিয়েছিলেন, তাঁর ভারতে ইস্পাত আনার পরিকল্পনা কথা৷
ইস্পাতের প্রযুক্তির দুটি অংশ- একটা হল ইস্পাত বিজ্ঞান অন্যটি হল উৎপাদনের প্রযুক্তি৷ কোনটা তিনি দেশে নিয়ে আসতে চান? স্বামীজির এই কঠিন প্রশ্ন ভাবিয়ে তোলে জামদেশজিকে৷ তাঁর মনে পড়ে এর আগে যখন ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল প্রযুক্তিগত সাহায্য নিয়ে ভারতে ইস্পাত উৎপাদন শুরু করলে তা ব্রিটিশরা কিনে নেবেন৷ ফলে টাটা বুঝতে পারছিলেন, ইস্পাত কারখানা গড়লে আখেরে তাঁর লাভের পাশাপাশি দেশের আপামর জনগণের পক্ষে মঙ্গল হবে৷ এরপরেই টাটা ঝুঁকে পড়লেন ইস্পাত কারাখানা গড়ার জন্য৷
১৮৯৩ এর ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম মহাসভায় বক্তৃতা দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন সওয়ামীজি৷ বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতে ফেরেন তিনি৷ ১৮৯৭ সালে কলকাতায় আসার পর বিবেকানন্দকে সংবর্ধনা দেয় গোটা শহর ৷ ততদিনে জাহাজযাত্রার সময়ের আলাপচারিতার কথা টাটার হৃদয়ে যেন গেঁথে গিয়েছে৷ ১৮৯৮ সালে ২৩ নভেম্বর বিবেকানন্দকে চিঠি লিখলেন জামশেদজি টাটা৷ জাহাজের ডেকে তাদের আলোচনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে অনুরোধ জানালেন ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রচারপত্র লিখে দিতে৷ কারণ জামশেদজি ভারতে বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা ভেবেছেন৷
বঙ্গে ক্ষমতায় এলে কৃষকদের একসঙ্গে ১৬ হাজার টাকা, প্রচারে বিজেপি
ততদিনে রামকৃষ্ণ মিশন নিয়ে বিবেকানন্দ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷ নিজে আসতে না পারলেও টাটার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি পাঠালেন ভগিনী নিবেদিতাকে৷ নিবেদিতা দেখা করেছিলেন জামশেদজির সঙ্গে। এবং বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়েছিল৷ যদিও তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন এই প্রস্তাব বাতিল করেন৷ কিন্তু পরিকল্পনা অনুসারে এগোতে থাকেন জামেশেদজি৷
বিবেকানন্দের মৃত্যু হয় ১৯০২ সালে। জামশেদজির মৃত্যু হয় ১৯০৪ সালে৷ কিন্তু টাটার পরবর্তী প্রজন্ম এর হাত ধরে সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ হয়৷ ১৯০৭ সালে জামশেদপুরে টাটা গোষ্ঠীর পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে গড়ে উঠল টাটা স্টিল ৷ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারখানাটি একটি বহুজাতিক সংস্থায় পরিণত হয়৷ পাশাপাশি এই শিল্পগোষ্ঠীর ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে দেশে বিদেশে ৷